• ঢাকা বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩ পৌষ ১৪৩১

কার স্বার্থে চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের তুলে দিতে হবে ?

   ২১ মে ২০২৫, ০৪:৩৫ পি.এম.

এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া

বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড চট্টগ্রাম বন্দর। এই বন্দরের চারটি টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশী কোম্পানিকে লিজ কেন দিতে চাচ্ছ সরকার ? কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা কী? বিদেশী কোম্পানিকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া কতটুকু যৌক্তিক? সকলেই এই বিষয়ে ভেবে দেখা প্রয়োজন। চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ও চট্টগ্রাম কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) বিদেশী অপারেটরদের হাতে লিজ দেওয়ার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় বন্দর কর্তৃপক্ষের (সিপিএ) দুজন কর্মকর্তার চাকরি হারানোর অভিযোগ উঠেছে ইতিমধ্যে। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এবং সংবাদপত্রে এই লিজ প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করে চিঠি লিখিছিলেন। এই ঘটনা দেশের প্রধান এই সমুদ্র বন্দরের ব্যবস্থাপনা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সাথে সাথে সরকারের কর্মকান্ডে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে তাহলে সরকার কি সত্যই দেশের স্বার্থ বিরোধী কাজ করতে যাচ্ছেন ?

পতিত ফ্যাসীবাদী স্বৈরাচারী সরকারের আমলে ২০২৩ সালের মার্চে সবচেয়ে বড় ও লাভজনক চট্টগ্রাম বন্দরের  নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশীদের লিজ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। শিদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে।  সেই সময় বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রচন্ড বিরোধিতার কারণে আওয়ামী সরকার সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছিল। সেই ফ্যাসীবাদী সরকারের সিদ্ধান্ত জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিচ্ছে কার স্বার্থে , কোন স্বার্থে ?

২০২৩ সালের মার্চে এনসিটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের আওতায় পরিচালনার জন্য অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে প্রকল্প অনুমোদন হয়েছিল। প্রকল্পের জন্য ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার নিয়োগ করা হয় ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনকে (আইএফসি)। গত বছরের ৫ নভেম্বর পিপিপি কর্তৃপক্ষ, আইএফসি ও বন্দর কর্তৃপক্ষের যৌথ সভায় প্রকল্পের টাইমলাইন ঠিক করা হয়। এর মধ্যে আইএফসি এ প্রকল্পের ট্রানজেকশন স্ট্রাকচারিং রিপোর্ট বা টিএসআর প্রদান করার কথা। এই প্রতিবেদন অনুমোদনের পর ডিপি ওয়ার্ল্ডকে আরএফপি (রিকুয়েস্ট ফর প্রপোজাল) দেওয়া হবে। আগামী নভেম্বরে এ ব্যাপারে একটি চুক্তি হওয়ার কথা। চুক্তি হলে টার্মিনালটি পুরোপুরি ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে চলে যাবে। তারা মাশুল আদায়, লোকবল নিয়োগ থেকে বন্দরকে এককালীন, বার্ষিক ও কনটেইনারপ্রতি অর্থও প্রদান করবে।

ইতিমধ্যে দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল অভিমত প্রকাশ করেছে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল দেশি প্রতিষ্ঠানের হাতেই থাকতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশী কোম্পানিকে লিজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হবে আত্মঘাতী। জাতীয় অর্থনীতির প্রধান লাইফ লাইন চট্টগ্রাম বন্দরকে বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। তাদের দাবী হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরকে বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া যাবেতো নাই সেইসঙ্গে বন্দরে পতিত আওয়ামী লীগের আমলের সব সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে।  

বিশ্লেষখরা চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশীদের হাতে লিজ দেওয়াকে দেশের স্বার্থবিরোধী বলে মনে করছেন। তাঁদের বক্তব্য হলো টার্মিনালটিতে দেশের টাকায় জেটি নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়েছে। জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানোর অত্যাধুনিক ‘গ্যান্ট্রি ক্রেন’ থেকে শুরু করে কনটেইনার স্থানান্তরে যত ধরনের যন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তার সবই রয়েছে টার্মিনালটিতে। বন্দর কর্তৃপক্ষ দরপত্রের মাধ্যমে দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে টার্মিনাল পরিচালনা করছে। এখানে এক হাজারের মতো শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করছেন। ১৭ বছর ধরে এ রকম লাভজনকভাবে চলতে থাকা একটি টার্মিনাল কেন -কাদের স্বার্থে বিদেশীদের হাতে ইজারা দিতে চাচ্ছে সরকার, সেই বিষয়টি স্পষ্ট নয়। অনেকে দক্ষতা ও আধুনিক প্রযুক্তির যুক্তি দেখালেও বিষয়টি যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ, টার্মিনালে ইতিমধ্যে সব প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতি প্রয়োজন তা তো রয়েছেই, যা ব্যবহার করে দেশীয় প্রতিষ্ঠান দক্ষতার সঙ্গে কনটেইনার ওঠানামা করছে। বন্দরে বিদেশী বিনিয়োগের ফলে নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির বদলে উল্টো বিদ্যমান কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল দেশের টাকায় নির্মিত হয়েছে। দেশের টাকায় কেনা হয়েছে যন্ত্রপাতি। বন্দর ও দেশীয় প্রতিষ্ঠান মিলে ইতোমধ্যে সক্রিয়ভাবে পরিচালিত এই টার্মিনালকে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিদেশীদের হাতে তুলে দেওয়ার আন্তর্জাতিক চক্রান্ত এখনও অব্যাহত আছে। নির্মাণের ১৭ বছর পর কেন একটি সফল টার্মিনালকে বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে হবে? এর পেছনে রহস্য কী? কেন জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সরকার ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে উঠেপড়ে লেগেছে? জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে কার স্বার্থ বাস্তবায়নে কাজ করছে এই অন্তর্বর্তী সরকার।

চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের লিজ দেওয়া হবে আত্মঘাতী। অভিজ্ঞতার দোহাই দিয়ে জাতীয় অর্থনীতির প্রধান লাইফ লাইন চট্টগ্রাম বন্দরকে বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত দেশের জনগণ মানতে পারে না।  নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত প্রধান সমুদ্রবন্দর বিদেশি কোম্পানির তত্ত্বাবধানে পরিচালনা করার তৎপরতা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি। এই সিদ্ধান্ত দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য হুমকির কারণ হতে পারে। জনগণের নির্বাচিত সরকার ছাড়া এই ধরনের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া দেশের জন্য বুমেরাং হতে পারে। জাতির এই কঠিন সময়ে এই সিদ্ধান্ত দেশের জন্য কোনও অবস্থায় কল্যাণ বয়ে আনবে না। তাই সরকারকে জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তায় ঝুঁকি সৃষ্টিকারী এই ধরনের সব তৎপরতা থেকে সরে আসতে হবে।

জি টু জি ভিত্তিতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) প্রকল্পে ন্যূনতম এক হাজার ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। যন্ত্রপাতিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ এই টার্মিনালে বিনিয়োগ কোথায় হবে, তা নিয়ে ইতোমধ্যে গণমাধ্যমেও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। মূলত দেশের স্টেকহোল্ডারদের বাদ দিয়ে কোনও পক্ষ ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে এই বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে উঠেপড়ে লেগেছে কেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ? টার্মিনালটি বিদেশি অপারেটরকে দিয়ে পরিচালনা করালে চট্টগ্রাম বন্দরের রাজস্ব আয় অর্ধেকের চেয়ে কমে যাবে। এতে করে ভবিষ্যৎ উন্নয়নমূলক কাজও থেমে যাবে, বা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উল্লেখযোগ্য আরও যেসব ক্ষতি হবে, এরমধ্যে রয়েছে— ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে নিয়োজিত শ্রমশক্তি কর্মসংস্থান হারাবে; বিদেশি অপারেটররা লাভের অংশ বিদেশি মুদ্রায় বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাবে; নতুনভাবে বৈদেশিক বিনিয়োগের কোনও সুযোগ নেই। ফলশ্রুতিতে এটি একেবারে আত্মঘাতী একটি সিদ্ধান্ত, যার পেছনে আন্তর্জাতিক চক্রান্তের বাইরে কিছু আছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন না। 

আমরা বিদেশি বিনিয়োগ চাই। কিন্তু সেই বিদেশি বিনিয়োগ হবে গ্রিন ফিল্ডে। আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি করা এনসিটি কেন বিদেশীদের দেওয়া হবে বোধগম্য নয়। বিগত স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগমুহূর্তে এনসিটি পরিচালনার ভার বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় তারা সেটি করতে পারেনি। এখন অন্তর্বর্তী সরকারও এনসিটি বিদেশীদের হাতে দেওয়ার জোর চক্রান্ত শুরু করেছে। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনা বিদেশি কোনো কোম্পানিকে লিজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হবে আত্মঘাতী ও অদূরদর্শী।

ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি ও অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় চট্টগ্রাম বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব অনেক। এই অবস্থায় নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালের পরিচালনার ভার বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়া কতটা যৌক্তিক তা ভেবে দেখতে হবে। বিভিন্ন মহলে ইতিমধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে এ ধরনের একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের আছে কি না ? বন্দর পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম, দুর্নীতি থাকলে সরকার বরং সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করার দিকে গুরুত্ব দিতে পারে। কেউ যেন ভুলে না যাই, অন্তর্বর্তী সরকারের মূল কাজ হলো জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের পাশাপাশি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করে জনগনের কাক্ষিত সরকার প্রতিষ্ঠা করা। দেশের স্বার্থ বিরোধী কোন কাজে যেন তারা জড়িত না হন এটাই কাম্য। 

[ এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া, কলাম লেখক, রাজনীতিক কর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক]
E-mail : [email protected]

ভিওডি বাংলা/ এমএইচ

[নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। ভিওডি বাংলা সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, ভিওডি বাংলা কর্তৃপক্ষের নয়] 

  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
মৎস্য বিজ্ঞান পেশা: জলাশয়ের সীমানা পেরিয়ে ক্যারিয়ারের নতুন দিগন্ত
মৎস্য বিজ্ঞান পেশা: জলাশয়ের সীমানা পেরিয়ে ক্যারিয়ারের নতুন দিগন্ত
জুলাই বিপ্লবের পোষ্ট মর্টেম: ছাত্র-বিএনপি নাকি সবার!
জুলাই বিপ্লবের পোষ্ট মর্টেম: ছাত্র-বিএনপি নাকি সবার!
‘আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ কাম্য নয়'
‘আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ কাম্য নয়'