রাজশাহী পবায় করলার বাম্পার ফলন ও ভালো দাম পাওয়ায় কৃষক খুশি


চারিদিকে সবুজের সমারোহ। সবুজ রঙের পাতার ফাঁকে হলুদ ফুল। মাচার নিচে ঝুলে আছে ছোট-বড় করলা। চলতি মৌসুমে করলা জাতীয় সবজির উৎপাদন ভালো হয়েছে। ক্ষেত পরিচর্যার পাশাপাশি বিক্রয়ের জন্য করলা সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। স্থানীয় বাজারে করলার চাহিদা বেড়েছে, পাশাপাশি সরবরাহ হচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। কম খরচে করলা সবজির বাম্পার ফলন হওয়ায় এবং বাজারদর ভালো থাকায় লাভবান হচ্ছেন প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরা। খরচ পুশিয়ে লাভ হওয়ায় কৃষকের মুখে ফুটেছে তৃপ্তির হাসি। এই হাসি সাফল্যের, এই হাসি কৃষির অগ্রগতির বহিঃপ্রকাশ।
সরেজমিনে পবা উপজেলার নওহাটা পৌরসভা, বড়গাছি, পারিলা, হরিয়ান, হুজুরীপাড়া, দামকুড়াসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের এলাকার মাঠ ঘুরে দেখা যায়, টিয়া, দুর্বার, বারি করলা-৩, রাজা-১২ ও ১৩ এবং যশোরী হাইব্রিড জাতের করলা চাষ করেছেন কৃষকরা। জমিতে স্থায়ী মাচা তৈরি করে করলার পাশাপাশি বরবটি, কাঁকরোল, লাউ, চিচিঙ্গা, শসা, তরই ছাড়াও মরিচ, পেঁপে বেগুন, ঢ্যাঁড়স, পটল, পুঁইশাক, ডাটাশাক সহ বিভিন্ন সবজি চাষ করেছেন তাঁরা। সাধারণ পদ্ধতি ছাড়াও আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি পরিবেশবান্ধব মালচিং পেপার ব্যবহারের মাধ্যমে করলা চাষ ছাড়াও একই জমিতে একই সঙ্গে তিন প্রকারের সবজি, করলা মাচার সাথে শসা ও নিচে বেগুন, মরিচ চাষ করেছেন অনেক চাষি।
নওহাটা পৌরসভার পাকুড়িয়া গ্রামের কৃষক জসিম উদ্দিন জানান, “উপজেলা কৃষি অফিস থেকে নিরাপদ বিষমুক্ত সবজি চাষে কৃষি বিষয়ক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ এবং নানাবিধ পরামর্শ অনুযায়ী চাষাবাদ করছেন। এক বিঘা জমিতে মালচিং পেপার ব্যবহারের মাধ্যমে রাজা-১২ ও ১৩ হাইব্রিড জাতের উচ্চ ফলনশীল করলা চাষ করেছেন। করলা ফসল চাষ করতে যা খরচ হয়েছে তা পুরোটাই উঠে গেছে এখন লাভের মুখ দেখছেন। মালচিং পেপার ব্যবহারে গাছকে অতিরিক্ত তাপমাত্রা ও অতি বৃষ্টি থেকে রক্ষা করে। সারের অপচয় রোধ করে, আগাছা দমন করে, মাটির আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে এবং রোগবালাই কম হয়। ফলে গাছের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়, করলার উৎপাদন বৃদ্ধি ও দ্বিগুণ ফলন হয় এবং বাজার মূল্য ভালো পাওয়া যায়।”
বড়গাছি ইউনিয়নের সবসার গ্রামের কৃষক সুমন আলী বলেন, “দুই বিঘা জমিতে উন্নত হাইব্রিড টিয়া ও যশোরী জাতের করলা চাষ করেছেন। জমি চাষ, বীজ, সার, বালাইনাশক, শ্রমিকের মজুরি, পরিবহণ খরচ সবমিলিয়ে চাষাবাদে খরচ হয়েছে এক লাখ টাকা। উৎপাদন খরচের তুলনায় করলা চাষ বেশি লাভজনক। রোগবালাই কম হওয়ায় ফলন ভালো হয়েছে। খরচের টাকা উঠে গেছে। এক হাজার ৮০০ টাকা মন হিসেবে পাইকারি দামে করলা বিক্রয় করেছেন। দাম স্বাভাবিক থাকলে দুই লাখ টাকা আয় করতে পারবেন বলে আশাবাদী তিনি। অভিজ্ঞ চাষীদের পরামর্শে পরিশ্রম ও মেধাশক্তি কাজে লাগিয়ে চাষাবাদ করে হয়েছেন আর্থিকভাবে সমৃদ্ধশালী।”
একই এলাকার কৃষক মুকুল হোসেন ও আফাজ উদ্দিন জানান, “করলা চাষ খুবই লাভজনক ফসল। তাঁরা এক বিঘা জমিতে উন্নত হাইব্রিড দুর্বার ও যশোরী জাতের করলা চাষ করেছেন। জমিতে নিয়মিত সেচ ও জৈব সারের ব্যবহার করলে করলার ফলন ভালো হয়। ধান, গম, শাক সবজির চাষাবাদ করেই তাঁদের জীবন জীবিকা চলে। আল্লাহর রহমতে ভালো ফলন হয়েছে, বাজারে দামও ভালো পেয়েছেন। স্থানীয় বাজারে এক হাজার ৬০০ টাকা মন হিসেবে পাইকারি দামে করলা বিক্রয় করেছেন।”
পবা উপজেলার খড়খড়ি বাজারের পাইকারি সবজি ব্যবসায়ী মোখলেছুর রহমান জানান, সকালে প্রতি মণ করলা পাইকারি বিক্রি হয়েছে ১৬০০ থেকে ১৮০০ টাকায় (প্রতি কেজি ৪০ থেকে ৪৫ টাকা)। পাইকারি বাজারে সরবরাহ ও চাহিদার উপর নির্ভর করে সবজির দাম ওঠা-নামা করে। স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সবজি সরবরাহ করা হচ্ছে। নওহাটা বাজারের সবজি বিক্রেতা সাকিব জানান, সকালে টাটকা সবজি সংগ্রহ করে সারা দিনে সেই সবজি বিক্রি করছেন। এক কেজি করলা ৬০ থেকে ৭০ টাকার মধ্যে বিক্রয় করছেন। এক দিনের সবজি পরের দিন বিক্রয় করা যায় না নষ্ট হয় কারণ এটি পচনশীল পণ্য। তাছাড়া পরিবহণ খরচ, খাজনা, দোকান ভাড়া সবমিলিয়ে খুব বেশি লাভ হয় না।
বায়া এলাকার সবজি ক্রেতা রফিকুল ইসলাম জানান, “স্থানীয় বাজারে সব ধরনের টাটকা সবজি পাওয়া যায়। এক কেজি করলা ৭০ টাকায় ক্রয় করেছেন। এখানে প্রান্তিক কৃষকরা সরাসরি ক্ষেত থেকে বিষমুক্ত নিরাপদ সবজি নিয়ে আসেন।”
উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জালাল উদ্দিন দেওয়ান বলেন, “কিছু জাতের করলা সারা বছর পাওয়া যায়। সব রকমের মাটিতে করলা চাষ হয়। তবে জৈব সার সমৃদ্ধ দো-আঁশ মাটিতে ভালো জন্মে। কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষকদের উন্নয়নে মাঠ পর্যায়ে রোগবালাই ও ক্ষতিকর পোকা দমনে ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহারসহ প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছেন। চাষাবাদের জমি ছাড়াও বসতবাড়ির আঙিনা, পতিত জমি, টবে সহজেই চাষ করা যায়। করলা সবজি চাষে রোগবালাই কম, অল্প পরিশ্রম এবং কম খরচে অধিক লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা। বাজারে দাম ভালো পাওয়ায় চাষিদের মুখে ফুটেছে তৃপ্তির হাসি ফলে করলা চাষে দিন দিন আগ্রহ বাড়ছে।”
পবা উপজেলার “উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা” কৃষিবিদ এম. এ. মান্নান জানান, “করলা নানা পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ তেতো স্বাদের উপকারী সবজি। শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, চর্মরোগ থেকে সুরক্ষা, ওজন এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। নিরাপদ ও বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনের লক্ষ্যে কৃষকদের আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ ও বালাইনাশক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণসহ মাঠ পর্যায়ে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাগণ নিয়মিত সুপরামর্শ দিচ্ছেন। এছাড়াও ফসল উৎপাদন ও বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকদের মাঝে কৃষি প্রণোদনা অব্যাহত আছে।”
ভিওডি বাংলা/ এমএইচ